আরণ্যক
♣আরণ্যক♣
বিভূতিভূষণের কাহিনীবয়নের পরিচিত গতির কিঞ্চিৎ বাইরে অবস্থান আরণ্যক-এর গল্পপ্রক্ষেপণ ও পরিবেশনশৈলী; অরণ্যরহস্য এবং অরণ্যবিনাশের কাহিনীর অন্তরালে বিপন্ন-অপরাধী শিল্পী যেন আঁকছেন সভ্যতার আগ্রাসনের ছবি। উপন্যাসে বিবৃত প্রকৃতিচরাচরের শান্ত-স্নিগ্ধতা বিপুল বিশ্বব্যাপী নাস্তির বিপরীতে মহাকালাশ্রয়ী চৈতন্যে দীক্ষার প্রান্তরে হাতছানি দিয়ে ডাকে; যে আহ্বান পার্থিব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চিন্তালোকের অন্ধকার থেকে অনেক দূরে এগিয়ে যেতে শক্তি যোগায়। কথাশিল্পী বিভূতির জীবনদর্শন এবং শিল্পাদর্শ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে থাকে জগৎকে-জীবনকে দেখবার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। ১৭ মে ১৯৪৩ সালে লেখা তাঁরই ডায়েরি থেকে আমরা জানতে পারি ।
আরণ্যক উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিত, পরিসর-প্রাসঙ্গিকতা ও ধরন সম্বন্ধে লেখক কাহিনী আরম্ভের আগেই জানাচ্ছেন: ‘মানুষের বসতির পাশে কোথাও নিবিড় অরণ্য নাই। অরণ্য আছে দূর দেশে, যেখানে পতিত-পক্ব জম্বুফলের গন্ধে গোদাবরী-তীরের বাতাস ভারাক্রান্ত হইয়া ওঠে, ‘আরণ্যক’ সেই কল্পনালোকের বিবরণ। ইহা ভ্রমণবৃত্তান্ত বা ডায়েরি নহে- উপন্যাস। অভিধানে লেখে ‘উপন্যাস’ মানে বানানো গল্প। অভিধানকার পণ্ডিতদের কথা আমরা মানিয়া লইতে বাধ্য। তবে ‘আরণ্যক’-এর পটভূমি সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়। কুশী নদীর অপর পারে এরূপ দিগন্ত-বিস্তীর্ণ অরণ্যপ্রান্তর পূর্বে ছিল, এখনও আছে। দক্ষিণ ভাগলপুর ও গয়া জেলার বন পাহাড় তো বিখ্যাত।’ বন্য-অশিক্ষিত-দরিদ্র-অসহায় মানুষের অদ্ভুত-অজ্ঞাত জীবনধারা আর প্রকৃতির ভিন্নতর এক মুগ্ধতার আবেশ তাঁর এই কাহিনীর ক্যানভাস। কী এক অনতিক্রম্য-দুর্বোধ্য অপরাধবোধ- অক্ষমতার অসহায়ত্ত যেন তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে এই গল্পের সব কথামালা! দায় মোচনের আর দায়িত্ব বহনের ভার তাঁকে হয়তো ক্লান্ত করেছে বহুকাল! সেই স্মৃতি তাঁকে তাড়া করছে কি? হয়তো করছে- ভয়ংকরভাবেই করছে।
এই উপন্যাসে লেখক প্রকৃতির নিবিড় রহস্যময়তা, মায়ালোক আর আদিমতায় খুঁজে পেয়েছেন জীবনের গাঢ়তম রূপ; দেখেছেন মানুষের বিচিত্র প্রবণতা আর উপলব্ধির নব নব রূপায়ন। অভিজ্ঞতা আর বিশেষণের নবত্বে তিনি সাজিয়েছেন গোটা কাহিনী। কাহিনীকারের দেখবার আর প্রকাশ করবার দৃষ্টিভঙ্গি অসামান্য। বিপুল বনরাজি- তার সুবিশাল প্রান্তর, গাছগাছালি, পরিচিত-অপরিচিত অদ্ভুত সব লতাপাতা, বিচিত্র পাখির সমাবেশ, বন্য প্রাণীর আনাগোনা, জ্যোৎস্নাশোভিত রাত্রির রহস্যময়তা, নির্জনতার নীরব-অসীম দুরধিগম্যতা, অচিন্ত্যনীয় বিরাটত্ব, অনাস্বাদিত সৌন্দর্য, অজস্র ফল-ফুলের শোভা, দারিদ্র্যপীড়িত নানান স্বভাবের মানুষের উপস্থিতি, জলাশয়ের মোহময় হাতছানি- সব মিলিয়ে আরণ্যক উপন্যাসে বিস্ময়কর অনুভূতির স্বপ্নরাজ্য আর গভীর শান্তি ও আনন্দের মালা সাজিয়েছেন কথানির্মাতা বিভূতি। বোধ করি তিনি অনুভব করেছেন যে, প্রকৃতির এই নিবিড় সান্নিধ্যে মানুষ এক সময় নিজের অজান্তেই ‘একপ্রকার অতল-সমাহিত অতিমানস চেতনা’ দ্বারা প্রভাবিত-পরিচালিত হয়ে নিজেকে ভিন্নরূপে প্রকাশ করতে থাকে। আর এ অনুভবও ‘আসে গভীর আনন্দের মূর্তি ধরিয়া’। যেমন:-
১. “দুর্ভাবনা সত্ত্বেও উদীয়মান চন্দ্রের সৌন্দর্য আমাকে বড় মুগ্ধ করিল।”
২. “জীবনে একবারও সে জ্যোৎস্নারাত্রি দেখা উচিত; যে না দেখিয়াছে, ভগবানের সৃষ্টির একটি অপূর্ব রূপ তাহার নিকট চির-অপরিচিত রহিয়া গেল।”
৩. “অনন্যমনা হইয়া প্রকৃতিকে লইয়া ডুবিয়া থাকো, তাঁর সর্ববিধ আনন্দের বর, সৌন্দর্যের বর, অপূর্ব শান্তির বর তোমার উপর অজস্রধারে এত বর্ষিত হইবে, তুমি দেখিয়া পাগল হইয়া উঠিবে, দিনরাত মোহিনী প্রকৃতিরানী তোমাকে শতরূপে মুগ্ধ করিবেন, নূতন দৃষ্টি জাগ্রত করিয়া তুলিবেন, মনের আয়ু বাড়াইয়া দিবেন, অমরলোকের আভাসে অমরত্বের প্রান্তে উপনীত করাইবেন।”
মানুষের জীবনের ছোটছোট স্বপ্ন আর অনুভূতিগুলোকে বিভূতি কথামালায় সাজিয়েছেন দারুণ মমতায়। সামান্য অথচ কাঙ্ক্ষিত বস্তু না-পাবার যন্ত্রণা, দিনরাত মনে পুষে রাখা স্বপ্নাবলি মানুষকে যে ভিন্ন এক চারিত্রিক মহিমা দান করে, তা বোধকরি বিভূতির মতো করে আর কেউ দেখাতে পারেননি। কয়েকটি নমুনা হাজির করছি:
১. একখানা লোহার কড়াই যে এত গুণের, তাহার জন্য যে এখানে লোক রাত্রে স্বপ্ন দেখে, এ ধরনের কথা এই আমি প্রথম শুনিলাম।
২. বেশ লোকগুলো। বড় কষ্ট তো এদের!
৩. অন্নভোজনলোলুপ সরল ব্যক্তিগুলিকে আমার সে-রাত্রে এত ভালো লাগিল! জীবনের নির্মোহতা আর সঞ্চিত কষ্টের বাড়-বাড়ন্ত থেকে মুক্তির আনন্দ আমরা দেখতে পাই বঞ্চিত গ্রাম্য বয়ঃবৃদ্ধ ধাওতালের চরিত্রের দৃঢ়তায়- ‘বিত্তে নিস্পৃহতা ও বৃহৎ ক্ষতিকে তাচ্ছিল্য করিবার ক্ষমতা যদি দার্শনিকতা হয়, তবে ধাওতাল সাহুর মতো দার্শনিক তো অন্তত দেখি নাই।
একাকীত্বের কষ্ট যেমন আছে, তেমনি রয়েছে এর ভেতরে লুকিয়ে থাকা অপার আনন্দ আর নিরিবিলি দিনযাপনের সুখ-সুখ অনুভূতি। বিভূতি তাঁর ফেলে-আসা দিনরাত্রির ছোটখাটো ঘটনাবলির বিস্ময়কর অনুভবেব সাথে যখন মিলিয়ে দেখেন স্ত্রী-কন্যাদিহারা জয়পালের নিঃসঙ্গ জীবনের আলো-আঁধারির মেলায়, তখন তিনি বুঝতে পারেন কীভাবে কষ্টপীড়িত মানুষগুলো দিনযাপনের বৈচিত্র্যহীন সঙ্গীছাড়া কঠিন পাটাতনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। জয়পালকে গল্পকথক জিজ্ঞেস করছে- ‘এই যে একা এখানে থাক, কারো সঙ্গে কথা বলো না, কোথাও যাও না, কিছু করও না- এ ভালো লাগে? একঘেয়ে লাগে না?’ নগরের আলো-বাতাস-না-দেখা জয়পাল; জীবনের স্বাভাবিক-বিশাল আনন্দরূপ-না-দেখা জয়পাল, যার কাছে জীবনের অন্য কোনো ধারণা নিরর্থক, কম্পনহীন গলায় জানায়- ‘কেন খারাপ লাগবে হুজুর? বেশ থাকি। কিছু খারাপ লাগে না।’ আবার তিনি প্রকৃতির আদিমতম সন্তান মানুষের অকৃত্রিমতাকে তুলে আনছেন অন্য এক পরিবেশন-কৌশলে। জানাচ্ছেন:
এই মুক্ত জ্যোৎস্নাশুভ্র বনপ্রান্তরের মধ্য দিয়া যাইতে যাইতে ভাবিতেছিলাম, এ এক আলাদা জীবন, যারা ঘরের দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকিতে ভালবাসে না, সংসার করা যাদের রক্তে নাই, সেইসব বারমুখো, খাপছাড়া প্রকৃতির মানুষের পক্ষে এমন জীবনই তো কাম্য।
এ পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে, যারা নিজের সম্বন্ধে তেমন কিছু বলে না; কিন্তু মুখের ভাব থেকেই বোঝা যায়- তারা খুব দুঃখি, এমন এক মানুষ অতিদরিদ্র পণ্ডিত-ধার্মিক-দার্শনিক রাজু পাঁড়ে। সংসারধর্মের চেয়ে ধর্মচর্চা আর জ্ঞানসাধনাই যার প্রধান অবলম্বন।
সামন্তপ্রভূদের সকল স্বাভাবিক প্রতাপ তাঁর মধ্যে বর্তমান; দুঃশাসন ও অত্যাচারে সে অতি কড়া, খুন-ঘরজ্বালানি-মিথ্যেমকদ্দমায় পাকা। তবে লেখক এঁকেছেন এই সামাজিক-আপাত দাপটের অন্তরালে বিরাজমান বর্বর প্রাচুর্যের ভয়ানক ছবি; অপরিচ্ছন-শিল্পকলাগন্ধবর্জিত গৃহপরিবেশ, অশিক্ষিত সন্তানাদি, রুচিহীন প্রতিবেশ, আধুনিক জীবনবোধের অভাব- এসব যে কোনো আভিজাত্যের লক্ষণ নয়- টাকা-পয়সার তাপজনিত কৃত্রিম সামাজিকতা, তা লেখক তাঁর পাঠককে উপলব্ধি করাতে চেষ্টা করেছেন।
গ্রাম্য এক কিশোর নৃত্যশিল্পী ধাতুরিয়ার উচ্চাশা আছে, ক্ল্যাসিক নৃত্যও সে আয়ত্ত করেছে বহু কষ্টে। গ্রামে নৃত্যের তেমন কদর নেই বলে সে কলকাতায় যেতে চায় জীবিকার জন্যে। কাহিনীনির্মাতা বলছেন: ‘ধাতুরিয়া শিল্পী লোক- সত্যিকার শিল্পীর নিস্পৃহতা ওর মধ্যে আছে।’ -এই ধাতুরিয়ার শিল্পপ্রীতি আর নগরমুখিতায় নিশ্চয়ই বিভূতি অন্য কোনো অভিনিবেশের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকবেন; কে জানে, তিনি হয়তো বলতে চান- মানুষ ক্রমাগত শিল্পের সৌন্দর্যের দিকে ধাবমান আর কর্ষণনির্ভর গ্রামকে দিনদিন গ্রাস করছে আকর্ষণনির্ভর শহর।
এই গ্রাম্য লোকগুলি অতি সরল। তাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধের সামান্যতম অভাব নেই। দায় আর দায়মোচনের ক্ষেত্রে এরা অতি সভ্য; ধার-দেনা পরিশোধের ব্যাপারে অকুণ্ঠ। পাত্র-পরিবেশ আর বর্ণনাকারীর অর্জিত জ্ঞান যে কাহিনী নির্মাণের জন্য অত্যন্ত জরুরি, তা বিভূতির এক অনুভব থেকে জানা আমাদের জন্য সহজ হয়। তিনি লিখছেন: ‘যেখানে-সেখানে যে-কোনো গল্প শোনা চলে না, গল্প শুনিবার পটভূমি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর উহার মাধুর্য যে কতখানি নির্ভর করে, তাহা গল্পপ্রিয় ব্যক্তি মাত্রেই জানেন।’- এই কথার ভেতর দিয়ে কেবল গভীর বনে বসে অশিক্ষিত কোনো এক মহিষ-রাখাল গনু মাহাতোর কাছে শোনা গল্পের তাৎপর্যই উঠে আসে না; লেখকের গল্প বলবার অভিপ্রায় এবং পরিবেশন-পরিবেশ-জ্ঞানের ব্যাপারাদিও আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রকৃতপক্ষে আরণ্যক এমন এক উপন্যাস যেখানে জীবনের বৃহৎ পরিসর আছে, বিচিত্র রূপ আছে: পরিবেশন গুণ আর পরিসর-ব্যাপকতার জন্য একে বলা চলে মহাকাব্যিক কাহিনী।
তথ্য সংগ্রহ
বিশ্ব নাথ মাহাত
সাকসেস বাংলা
Comments
Post a Comment