জাগরী রহস্য



              #জাগরী_রহস্য

ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলের ঠান্ডা মেঝেতে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কী যেন লিখে চলেছেন এক বন্দি।

যে সে বন্দি নন, রাজবন্দি। জেলের ভেতরেও তিনি কড়া নজরদারিতে থাকেন।

আগে একবার দলবল নিয়ে জেল ভেঙে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। সেই স্মৃতি ঘাড়ের পাশে পুলিশের রুলের মোটা দাগ নিয়ে জেগে।

কয়েক দিন আগেই তিনি জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে আর্জি জানিয়েছেন তাঁকে যেন কোনও একটি ‘টি সেলে’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শুনে সুপারিন্টেন্ডেন্টের মাথায় হাত! এই বন্দি বলে কি!

টি সেলগুলোতে রাখা হয় খতরনাক বন্দিদের। ছোট্ট খুপরি, একা একা থাকা। আলো বাতাস ঢোকে না বললেই চলে। সেখানে কেউ সাধ করে ঢুকতে চায়?

সুপারিন্টেন্ডেন্ট জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, ‘‘বলেন কী মশাই! ওখানে কেন?’’

বন্দির উত্তর, ‘‘একা থাকলে লেখাপড়ার কাজটা ভাল হয়।’’

‘‘বেশ, ব্যবস্থা করছি তাহলে।’’

ব্যবস্থা হল। আর ওই টি-সেলে বসেই রুল টানা খাতায় লেড পেন্সিলে লেখা হল এক উপন্যাস, যার নাম জাগরী।

লেখক ‘ভাদুড়ীজি’। সতীনাথ ভাদুড়ী। সময়টা ১৯৪২। গোটা ভারতবর্ষ তখন গাঁধীজির ভারত ছাড় আন্দোলনের জ্বরে কাঁপছে।  লেখক হিসেবে একেবারেই নতুন, কে পড়বে তার ওই লেখা?

জেলে বসেই সেই লেখা পড়ে ফেললেন তাঁর এক অনুগত শিষ্য, তিনিও রাজবন্দি। ‘ময়লা আঁচল’-এর লেখক ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’। পড়ে শুধু মুগ্ধই হলেন না, কেঁদে ফেললেন। ‘ভাদুড়ীজি’র পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন, ‘‘আমি ধন্য হলাম এই অসামান্য উপন্যাসের প্রথম পাঠক হতে পেরে।’’

বরাবরের রসিক, প্রাণোচ্ছ্বল সতীনাথ নাকি তখনও একই রকম। চোখের জল ফেলার সময় ফণীশ্বরের হাতে ধরা ছিল চায়ের কাপ। তাই দেখে বলে উঠলেন, ‘‘আহা করো কী ফণী, চা যে নোনতা হয়ে যাবে!’’

‘জাগরী’ প্রকাশ হওয়া নিয়েও এক মস্ত গল্প। সতীনাথ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সেই পাণ্ডুলিপি পড়েই রইল বাক্সবন্দি হয়ে। চিরকালেরই মিতভাষী সতীনাথ।

নিজের সম্পর্কে তো একেবারেই বলিয়ে কইয়ে নন, সুতরাং জেলের ভেতর কী লিখেছেন কেই বা জানবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি আর চাপা রইল না।

‘বনফুল’, অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সতীনাথের পরম বন্ধু। তাঁর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সতীনাথের। একদিন গেলেন বনফুলের বাড়ি। কথায় কথায় সংকোচে বলেই ফেললেন, ‘‘একটি উপন্যাস লিখে ফেলেছি জেলে বসে, একবার পড়ে দেখবে?’’

‘‘আরে অবশ্যই দিয়ে যাও।’’

কয়েক দিনের মধ্যেই পড়ে ফেললেন গোটা উপন্যাসখানি। মুগ্ধ! আহ কী লিখেছে সতীনাথ! আবার ডেকে পাঠালেন বন্ধুকে।

‘‘কী লিখেছ তুমি! এ যে অসামান্য! এক্ষুনি এই উপন্যাস ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’’

‘‘কিন্তু আমার যে কোনও সম্পাদকের সঙ্গে পরিচয়ই নেই।’’

‘‘দাঁড়াও, আমি ব্যবস্থা করছি। আমার ভাই ঢুলু-র (অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র পরিচালক)। সঙ্গে সাগরময় ঘোষের ভাল পরিচয় আছে। ওঁর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’’ সাগরময় তখন দেশের সহ সম্পাদক। অরবিন্দ নিজে গেলেন পত্রিকার দফতরে। সাগরময় ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে। ‘জাগরী’র পাণ্ডুলিপিও জমা দিলেন। সাগরবাবু বললেন, ‘‘একমাস পর এসে খোঁজ নিতে।’’

একমাস পর আবার গেলেন অরবিন্দ। সাগরবাবু পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে বললেন, ‘‘অমনোনীত।’’

অরবিন্দ শুনে অবাক, ‘‘সে কী! সাগরদা আপনি নিজে পড়েছেন?’’

‘‘না আমি পড়িনি, তবে যিনি পড়েছেন তিনিও সাহিত্যের মস্ত সমঝদার।’’

ফেরত চলে এল ‘জাগরী’। এবার উপায়? হাল ছাড়ার পাত্র নয় অরবিন্দ। সোজা গেলেন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের বাড়ি।

‘‘দাদা এই উপন্যাসটা একবার পড়ে দেখবেন? একজন নতুন লেখক।’’

দু’দিন পরেই কাকভোরে অরবিন্দবাবুর বাগবাজারের বাড়ির নীচে সজনীকান্তর ডাকাডাকি।

‘‘এক্ষুনি নীচে এসো। আরে এ কে! কী সাংঘাতিক লেখা! এই লেখা এক্ষুনি ছাপাতে হবে।’’

‘‘আপনি ছাপবেন?’’

‘‘ছাপতে পারলে ধন্য হতাম। আমার পত্রিকায় এখন তারাশংকর আর বনফুলের ধারাবাহিক উপন্যাস বেরোচ্ছে, কবে শেষ হবে জানি না। কিন্তু তত দিন এই লেখা ফেলে রাখলে চলবে না। এখনই পাঠকদের কাছে পৌঁছানো দরকার। ব্যবস্থা করছি। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি চিঠি আর এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে এখনই যোগাযোগ করো।’’

সজনীকান্ত চিঠি লিখলেন একটি হিন্দি দৈনিকের সম্পাদককে। চিঠির বয়ান, ‘‘তুমি জাগরী ছাপবে। ছেপে ধন্য হবে।— সজনীকান্ত দাস’’

লালচে নিউজপ্রিন্টে সরাসরি বই হয়ে জাগরী-র গতি হল। আর প্রকাশ হওয়া মাত্রই বাংলার পাঠক মহলে হইহই। তারপর? সতীনাথ ভাদুড়ী নামের এক নতুন লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’ পেল প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার।

সাগরময় ঘোষ ছুটলেন সতীনাথ ভাদুড়ীর বাড়ি। একবার বড় ভুল হয়ে গেছে খাঁটি হীরে চিনতে, দ্বিতীয়বার আর নয়। নিজেকেই নিজে বললেন, ‘‘আমাদের একটা উপন্যাস দিতেই হবে।’’

ফেরাননি সতীনাথ। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ পেল তাঁর আরেক কালজয়ী উপন্যাস— ঢোঁড়াই চরিত মানস।



**তথ্য সূত্র :-**
**আনন্দবাজার রবিবাসরীয় প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে**


**তথ্য সংগ্রহ :-**
**বিশ্ব নাথ মাহাত**
**ডোরান্ডা কলেজ**
**রাঁচি বিশ্ব বিদ্যালয়**

Comments

Popular posts from this blog

চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রশ্ন উত্তর

আরন্যক প্রশ্ন উত্তর :-

চর্যা_পদ